পবিত্র মাহে রমজান ও ঈদুল ফিতরকে ঘিরে প্রবাসী কর্মজীবীরা প্রতি বছরই দেশে স্বজনদের কাছে অন্য সময়ের তুলনায় বেশি রেমিট্যান্স পাঠান। কিন্তু এবারের রমজানে দেখা দিয়েছে ভিন্ন পরিস্থিতি।
গত ফেব্রুয়ারিতে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স আসার পরের মাস মার্চে না বেড়ে উল্টো কমেছে। ডলারের চাহিদা যখন তুঙ্গে তখন প্রবাসী আয়ের এমন ভাটা চিন্তায় ফেলেছে নীতিনির্ধারকদের। নিম্নমুখী রিজার্ভ চাপের মুখে পড়ছে। রেমিট্যান্সপ্রবাহে এমন পরিস্থিতি দেখা দেওয়ার নেপথ্যে তিনটি কারণ কাজ করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এ তিন কারণের মধ্যে রয়েছে- প্রথমত. হুন্ডির লাগাম টানতে না পারা; দ্বিতীয়ত. নির্ধারিত দরের পরও অনানুষ্ঠানিক যে দর ছিল তা কমে যাওয়া বা বাড়তি প্রণোদনা দিতে ব্যাংকগুলোর অনাগ্রহ; এবং তৃতীয়ত. ঈদের আগে অন্য বছরের তুলনায় এবার প্রবাসীদের কম পরিমাণে টাকা পাঠানো।
নিত্যনতুন উপায়ে জাল বিস্তার করছে হুন্ডি চক্র
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অনেক প্রচেষ্টার পরও হুন্ডির লাগাম টানা যাচ্ছে না। ব্যাংক যত বেশিই অফার করুক না কেন, হুন্ডিতে তার চেয়ে বেশি দর হাঁকানো হচ্ছে। নিত্যনতুন উপায়ে হুন্ডি চক্র তাদের জাল বিস্তার করছে। এদিকে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা লোকজনও হুন্ডি ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব কারণে হুন্ডি থামানো যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘হুন্ডি থামাতে প্রতিদিন অন্তত ২০০ হিসাব বন্ধ করা হচ্ছে।’ সিআইডি কার্যালয়ে আয়োজিত প্রশিক্ষণ কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে গভর্নর এ বিষয়ে শক্ত পদক্ষেপ নিতে সিআইডির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘নতুন করে ঘোষিত আড়াই শতাংশ প্রণোদনার সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর করতে ডলার রেট পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। তা না হলে ডলার অবৈধ চ্যানেলে লেনদেনের পথ শক্তিশালী হবে। পাশাপাশি বাজারে নজরদারি বাড়াতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘পাচার ঠেকাতে না পারলে হুন্ডিতে ডলারের চাহিদা কমবে না। হুন্ডিতে যদি ডলারের চাহিদা বেশি থাকে তাহলে যেকোনো ব্যাংকের চেয়ে বেশি দরে ডলার হুন্ডিতে চলে যাবে।’
ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে লোকসান দিয়ে
রেমিট্যান্স পতনের দ্বিতীয় কারণ হলো- রেমিট্যান্সের অনানুষ্ঠানিক দর কমে গেছে। প্রবাসী আয় কেনার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোতে এখন ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ১১০ টাকা। তবে ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো ডলারপ্রতি ১২২ টাকারও বেশি দামে প্রবাসী আয় কিনছিল। এখন অবশ্য এই দর কমে ১১৫ থেকে ১১৬ টাকায় নেমে এসেছে। তাই রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমে গেছে।
ব্যাংকাররা জানাচ্ছেন, ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার হোল্ডিং বেড়ে যাওয়ার কারণে রেমিট্যান্সের চাহিদা কমে গেছে। সরকারি ও বেসরকারি একাধিক ট্রেজারি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংকগুলো এখন এলসি খোলা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে রেমিট্যান্সের চাহিদাও কমছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সোয়াপ করে নগদ টাকা বন্ডে বিনিয়োগ করে বাড়তি মুনাফা অর্জন করতে চাইছে অনেক ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাড়তি দামে রেমিট্যান্স কিনতে ব্যাংকগুলোকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। তবুও তারা বেশি দরে ডলার কিনছেন না। কারণ বেশি দরে কিনে কম দরে বিক্রি করে লোকসান গুনতে চাইছে না ব্যাংকগুলো। আগে ডলারের ব্যাপক চাহিদা থাকায় বেশি দরে ডলার কিনে কালোবাজারে বেশি দরে বিক্রি করত ব্যাংকগুলো। আবার আমদানিকারকের কাছ থেকেও অনানুষ্ঠানিক বেশি দর নেওয়া হতো।
নাম প্রকাশ না করে অগ্রণী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘জরুরি প্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি ঈদের আগে খুলেছে ব্যবসায়ীরা। তখন অনেক ব্যাংকই বর্ধিত দাম নিয়েছে। এখন বেশি দাম চাইলে দরকষাকষি করছেন আমদানিকারকরা। তাই অনানুষ্ঠানিক দর কমে এসেছে।’
তাছাড়া সরকারের দেওয়া আড়াই শতাংশ প্রণোদনার বাইরে ব্যাংকগুলোকে আরও আড়াই শতাংশ প্রণোদন দেওয়ার সুযোগটিকে এখন আর দিতে চাইছে না অনেক ব্যাংক। কারণ অনানুষ্ঠানিক দর কমে যাওয়ায় লোকসান দিয়ে ডলার বিক্রি করতে হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, বেশি দরে ডলার কিনে কম দরে বিক্রি করার নীতি কখনও বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে না। বর্তমানে সে চিত্রই দেখা যাচ্ছে।
রেমিট্যান্স ঠিকই আছে- বলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
প্রবাসী আয় কমার তৃতীয় কারণ হিসেবে প্রবাসীদের কম অর্থ পাঠানোকে চিহ্নিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ফেব্রুয়ারি মাসে রোজা ও ঈদের খরচ একসঙ্গে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। কারণ আরবি ও ইংরেজি মাস শেষ হওয়ার হিসাব বিবেচনায় প্রবাসীরা টাকা পাঠিয়েছেন। মার্চে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘রেমিট্যান্স ঠিকই আছে। রোজা ও ঈদের খরচ একসঙ্গে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। তাই ফেব্রুয়ারি মাসে একটু বেশি ছিল। পরের মাসে যা এসেছে তা কম বলা যাবে না।’
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র বলছে, ব্যাংকে টাকা আসতে কিছু জটিলতার কারণে ঈদের আগে অনেক প্রবাসী হুন্ডিতে সহজে ও দ্রুত সময়ে টাকা পাঠাচ্ছেন। তাছাড়া বাড়তি দরও পাওয়া যাচ্ছে। সব মিলিয়ে আনুষ্ঠানিক পথে রেমিট্যান্সপ্রবাহ সামনের দিনগুলোতে আরও কমার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রবাসীরা গত মাসে ১৯৯ কোটি ৬৮ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন, গত বছরের একই মাসে যার পরিমাণ ছিল ২০২ কোটি ২৪ লাখ ডলার। সে হিসাবে রেমিট্যান্সপ্রবাহ ১ দশমিক ২৬ শতাংশ কমেছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির তুলনায়ও মার্চে রেমিট্যান্স কমেছে। ফেব্রুয়ারিতে দেশে প্রবাসী আয় এসেছিল ২১৬ কোটি ৪৫ লাখ ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৭০৭ কোটি বা ১৭ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে প্রবাসীরা ১৬ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৪২ শতাংশ। তবে যত বাংলাদেশি বিদেশে গেছেন, সে অনুপাতে রেমিট্যান্স বাড়েনি।
বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে রেকর্ড ১৩ লাখ ৫ হাজার ৪৫৩ বাংলাদেশি জীবিকার সন্ধানে অভিবাসী হয়েছেন। আগের বছর অভিবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩। অর্থাৎ গত দুই বছরে ২৪ লাখের বেশি বাংলাদেশি কাজের জন্য বিদেশে গেলেও রেমিট্যান্স সে অনুপাতে বাড়েনি। বিশেষ করে প্রধান শ্রমবাজার সৌদি আরবে রেকর্ড সংখ্যক শ্রমিক অভিবাসী হলেও দেশটি থেকে রেমিট্যান্সপ্রবাহ অর্ধেকে নেমে এসেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ছাড়া প্রধান অন্য শ্রমবাজারগুলো থেকেও প্রবাসী আয় আসার প্রবাহ কমে যাচ্ছে।
দেশে রেমিট্যান্সপ্রবাহে বড় বিপর্যয় দেখা দেয় চলতি অর্থবছরের শুরুর দিকে। গত আগস্টে প্রবাসীরা ১৬০ কোটি ডলার পাঠিয়েছিলেন। সেপ্টেম্বরে তা ১৩৩ কোটি ডলারে নেমে যায়।
এদিকে, এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘রেমিট্যান্স বাড়াতে হলে দক্ষ জনশক্তি বিদেশে পাঠাতে হবে। তাছাড়া পাচার ঠোকাতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন news@probashtime.com মেইলে।
