বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা, শিক্ষা ও জনশক্তি উন্নয়ন শাখার একটি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ২১ কোটি ৭২ লাখ টাকা লুটপাটের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত কর্মসূচির (এইচপিএনএসপি) আওতায় প্রায় ৫ বছর আগে ৩১টি প্যাকেজে ওই প্রশিক্ষণের নামে সরকারি অর্থ আত্মসাতের ঘটনার সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ এবং সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের তৎকালীন এপিএসের এক ভাইসহ ১১ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। চারটি দেশে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে আলাদাভাবে এই টাকা পাঠানো হয়। দুদক কর্মকর্তাদের ধারণা, পরে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা দেশে আনা হয়।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিদেশে ওই প্রশিক্ষণ বাস্তবায়নের জন্য ৪২৬ জনের নামে সরকারি আদেশ (জিও) জারি করা হয়। এতে প্রশিক্ষণার্থীদের দৈনিক সম্মানী ও বিমান ভাড়াসহ ৭ কোটি ৩৫ লাখ ৮৩ হাজার ৬৭৫ টাকা এবং টিউশন, ইনস্টিটিউশনাল ও প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট ব্যয় বাবদ ১৪ কোটি ৩৭ লাখ ১১ হাজার ৪৭২ টাকা অগ্রিম প্রদানের অনুমতি দেওয়া হয়। এই ৪২৬ জনের বিপরীতে ২১৮ জনকে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়।
৭ ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে টাকা প্রেরণ : দুদক জানায়, ২০১৯ সালে বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে অর্থ লুটপাটের অভিযোগ পেয়ে একই বছর অনুসন্ধানে নামে দুদক। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ওই বছরের ৪ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা, শিক্ষা ও জনশক্তি উন্নয়ন শাখা থেকে পৃথক সাতটি স্মারকে প্রশিক্ষণের অনুমোদন দেওয়া হয়।
এর মধ্যে একটি স্মারকে ৭২ জনকে মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালায়া জিডি মাল্টি স্পেশালিস্ট হসপিটালের অধীন প্রশিক্ষণের অনুমোদনের কথা বলা হয়। সে অনুযায়ী এ প্রতিষ্ঠানের কথা বলে একটি ই-মেইল আইডিতে প্রশিক্ষণের প্রস্তাব পাঠানো হয়।
দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, যে ই-মেইল আইডিতে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে সেটি ভুয়া এবং এটি বাংলাদেশ থেকেই তৈরি করা হয়েছে। এর সঙ্গে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের তৎকালীন এপিএস শেখ আরিফুর রহমানের ভাই শেখ আলতাফুর রহমানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। দুদকের অনুসসন্ধানে দেখা যায়, মালায়া ইউনিভার্সিটিতে প্রশিক্ষণের কথা থাকলেও প্রশিক্ষণের ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা পাঠানো হয় থাইল্যান্ডের থামাসাট ইউনিভার্সিটির নামে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। এ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট প্রকৃতপক্ষে শেখ আলতাফুর রহমানের।
আরেকটি স্মারকে ৪২ জনকে মালয়েশিয়ার মাহশা ইউনিভার্সিটি মেডিসিন ফ্যাকাল্টিতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও সে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুদককে জানানো হয়, এ ধরনের কোনো প্রোগ্রামের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। কিন্তু একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট দেখিয়ে ৭০ লাখ ৩১ হাজার টাকারও বেশি অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে নিয়ে যাওয়া হয়।
এদিকে ৫৬ জনকে প্রশিক্ষণের কথা এক স্মারকে উল্লেখ করা হয়। সে অনুযায়ী থাইল্যান্ডের পাইথাই নওয়ামিন হসপিটালের নামে প্রতিষ্ঠানে দুইবারে ৭ কোটি ৬৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা একটি অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়। প্রকৃতপক্ষে এসব টাকা ভুয়া প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে পাঠানো হয়েছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণ পাওয়া যায়।
অন্যদিকে আরেকটি স্মারকে অনুমোদিত ইন্দোনেশিয়ার প্রতিষ্ঠান এআইটি নেটওয়ার্কের নামে ৮ জনকে প্রশিক্ষণের কথা বলা হলেও দুদকের অনুসন্ধানে ওই প্রতিষ্ঠানের নামে বাংলাদেশে বসে তৈরি করা একটি ই-মেইল আইডিতে প্রস্তাব পাঠানো হয়। ওই প্রশিক্ষণের নামে ইন্দোনেশিয়াতে প্রশিক্ষণার্থীদের কথা বলে মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে ২৭ লাখ ২০ হাজার টাকা পাঠানো হয়। একইভাবে আরেকটি স্মারকে ৫৩ জনের প্রশিক্ষণের কথা বলে একইভাবে আরও ১ কোটি ৫৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে।
আরেকটি স্মারকে অনুমোদনের কথা উল্লেখ করে শ্রীলংকাতে ৯ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলা হয়। দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, শ্রীলংকার কনকুয়েস্ট সলিওশন প্রাইভেট লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও আসলে এটি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়। সেখানে প্রশিক্ষণের কথা বলে দেশটির একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৩০ লাখ ৬০ হাজার টাকা পাঠানো হয়েছে।
আরেকটি স্মারকে ১৮ জনকে ইন্দোনেশিয়ার পিটি এআইটি জেজারিং নামে একটি প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নেওয়া কথা বলা হয়। দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, এ নামে দেশটিতে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। এটি একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। ওই প্রশিক্ষণের কথা বলে দেশটির একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দুইবারে ১ কোটি ৯০ লাখ ৪০ হাজার টাকা পাঠানো হয়।
অভিযুক্ত ১১ জন : অনুসন্ধান কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দুদকের প্রতিবেদন বলছে, অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ১১ কর্মকর্তা-কর্মচারী পরস্পর যোগসাজশে ২১৮ জন প্রশিক্ষণের নামে বিদেশে ভুয়া প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে মোট ২১ কোটি ৭২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। সাবেক ডিজি আবুল কালাম আজাদ ১৫ দিনব্যাপী এসব প্রশিক্ষণের জন্য অর্থ অবমুক্তি ও ব্যবহারের (আরপিএ-জিওবি) প্রশাসনিক অনুমোদন প্রদান করেন।
দুদকের অনুসন্ধানে বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে সরকারি অর্থ আত্মসাতের ঘটনার সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক ডিজি আবুল কালাম আজাদ ও লাইন ডিরেক্টর নাজমুল ইসলামসহ ১১ জনের নাম উঠে এসেছে। অন্যরা হলেন- চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন শাখার প্রোগ্রাম ম্যানেজার (বৈদেশিক প্রশিক্ষণ) মো. নাসির উদ্দিন, ডেপুটি ম্যানেজার ডা. মোস্তফা কামাল পাশা ও ডা. শামীম আল-মামুন।
সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর মো. লায়াল হাসান, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর মো. আলমগীর হোসেন, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর সুভাষ চন্দ্র দাস, থামাসাট ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত ড. শেখ আলতাফুর রহমান, থাইল্যান্ডে বসবাসরত সরফরাজ নেওয়াজ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কনসালটেন্ট ডা. জাবেদ আনোয়ার।
তদন্তেই পাঁচ বছর পার : ২০২০ সালের শুরুতে করোনাভাইরাসের মহামারীর সময় স্বাস্থ্য খাতে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশের পর আলোচনায় আসেন তৎকালীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি আবুল কালাম আজাদ। ওই সময় মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স নিয়ে করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ এবং চিকিৎসার জন্য চুক্তি করে সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমের সঙ্গে দুদক মামলায় আসামি হন আজাদও।
তবে এর আগের বছর বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে অর্থ লুটপাটের এই অভিযোগ অনুসন্ধানে নামে দুদক। কিন্তু গত পাঁচ বছরে দুইবার অনুসন্ধান শেষে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করলেও তা অনুমোদন দেয়নি দুদক।
দুদক থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের ১ অক্টোবর প্রথমে এ অনুসন্ধানের দায়িত্ব পান দুদকের কর্মকর্তা মো. আলী আকবর। এরপর তিনি অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের বক্তব্যের জন্য নোটিশ পাঠালেও তৎকালীন ডিজিসহ আরও অনেকে দুদকে আসেননি। তবে নাজমুল ইসলাম, নাসির উদ্দিন, সুভাষ চন্দ্র দাস দুদকে উপস্থিত হয়ে তাদের বক্তব্য দিয়েছেন। পরে কমিশনের সিদ্ধান্তে একই বছরের ২১ নভেম্বর দুদকের তৎকালীন উপপরিচালক মো. শামছুল আলমকে এই অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এরপর দীর্ঘ এক বছর এ অনুসন্ধান থেমে ছিল। পরে কমিশনের সিদ্ধান্তে ২০২১ সালের ১৬ আগস্ট সহকারী পরিচালক জালাল উদ্দিনকে এ অনুসন্ধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর কিছুদিন পর ১৯ আগস্ট পুনর্বার অনুসন্ধানের দায়িত্ব পান উপপরিচালক আলী আকবর। এর মধ্যে একবার অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করা হলেও তা গ্রহণ করেনি দুদক।
সর্বশেষ ২৫ নভেম্বর ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা সুপারিশ করে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করেন দুদক কর্মকর্তা আলী আকবর। সে প্রতিবেদনও গ্রহণ না করে বেশকিছু কোয়ারি দেয় কমিশন। এরপর আলী আকবর অবসরকালীন ছুটিতে গেলে নতুন করে এ অনুসন্ধানের দায়িত্ব পান দুদকের উপপরিচালক মশিউর রহমান।
পাঁচ বছরেও এ অনুসন্ধান শেষ না হওয়ার বিষয়ে জানতে গত রবিবার দুদকের কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হকের কার্যালয়ে গেলে তিনি অনুসন্ধানের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, আমি এ বিষয়ে কোনো মতামত দিতে পারি না। তবে তিনি বলেন, যেহেতু নতুন একজন কর্মকর্তা অনুসন্ধানের দায়িত্ব পেয়েছেন, তাহলে এ অনুসন্ধানের সময় শেষ হয়ে যায়নি।
অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে তিন দিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক ডিজি আবুল কালাম আজাদের ফোনে একাধিকবার ফোন দিয়েও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। যে কারণে এ বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া অধিদপ্তরের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলামের ফোনে একাধিকবার কল ও এসএমএস পাঠিয়েও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
