আমেরিকার ফেডারেল সরকারের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতাসংক্রান্ত কমিশন (ইউএসসিআইআরএফ) ভারতের গুপ্তচর সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং (র)’কে নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করেছে। মঙ্গলবার প্রকাশিত বার্ষিক রিপোর্টে ইউএসসিআইআরএফ ভারতে সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার দল বিজেপিরও সমালোচনা করেছে। তবে মার্কিন কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের পরপরই কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে নয়াদিল্লি। বলেছে, ওই রিপোর্টটি একপেশে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
‘রয়টার্স’ জানিয়েছে, শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হত্যার চেষ্টায় ‘র’র যোগসূত্র রয়েছে। সে কারণেই ইউএসসিআইআরএফ এ সুপারিশ করেছে। ইউএসসিআইআরএফের মূল কাজ হলো বিভিন্ন দেশের ধর্মীয় স্বাধীনতাসংক্রান্ত বিষয়ের ওপর নজর রাখা। সেই সঙ্গে আমেরিকার সরকারকে নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা। খালিস্তানপন্থি নেতা মার্কিন নাগরিক গুরপতবন্ত সিংহ পন্নুনকে ২০২৩ সালে হত্যা করা হয়। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই দাবি করে, ভারতে ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষিত সংগঠন ‘শিখ ফর জাস্টিস’র (এসএফজে) নেতা পন্নুনকে হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন ‘র’র সাবেক কর্তা বিকাশ যাদব। যদিও নয়াদিল্লি তখনই জানিয়ে দিয়েছিল, ওই ঘটনার সঙ্গে ভারত সরকারের কোনো যোগাযোগ নেই। রয়টার্স জানিয়েছে বিকাশ এবং ‘র’-উভয়ের উপরেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার জন্য সুপারিশ করেছে মার্কিন কমিশন।
প্রতিবেদনের কি ফাইন্ডিংয়ে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত ছিল। কারণ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হামলা এবং বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। জুনে জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সদস্যরা রাজনৈতিক সমর্থন আদায়ের জন্য মুসলমানসহ অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করেছিলেন। তাদের ওই বক্তব্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা উসকে দিয়েছিল। এ হামলা নির্বাচনের পরেও অব্যাহত ছিল। এসব হামলার মধ্যে ছিল সহিংসতা, বিদ্বেষের জেরের লক্ষ্যবস্তু ও নির্বিচারে হত্যা এবং সম্পত্তি, উপাসনালয় ধ্বংস। কর্তৃপক্ষ বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন এবং বিদেশি অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইনের মতো সন্ত্রাসবিরোধী এবং অর্থায়ন আইনের মাধ্যমে বিভিন্ন নাগরিক ও সামাজিক সংগঠনের ওপর দমন-পীড়ন এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সদস্য, মানবাধিকার রক্ষাকারী এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতিবেদনকারী সাংবাদিকদের আটক করেছে। ‘ভারতের সার্বভৌমত্ব, ঐক্য এবং অখণ্ডতার জন্য বিপদ’ বলে মনে করা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সরকার ফৌজদারি আইনে নতুন ধারা সংযোজন করে তাদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে।
মার্চে বিজেপি ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) বাস্তবায়নের জন্য নীতিমালা করে। ওই আইনে পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসা অমুসলিম সংখ্যালঘুদের দ্রুত নাগরিকত্ব প্রদানের বিধান করা হয়েছিল। ২০১৯ সালে সিএএর বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করার অপরাধে বেশ কয়েকজনকে আটক রাখা হয়েছিল। এদের মধ্যে ছিলেন উমর খালিদ, মীরান হায়দার এবং শারজিল ইমাম। জাতীয় নাগরিক নিবন্ধকের (এনআরসি) সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সব বাসিন্দাকে নাগরিকত্বের প্রমাণ দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। সিএএ মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করে যে, কর্তৃপক্ষ তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দিতে পারে। জুলাইয়ে আসামের ‘ফরেইনার্স ট্রাইব্যুনাল’ ২৮ জন মুসলিমকে ‘নাগরিক নন’ ঘোষণা করে এবং তাদের নির্বাসন কেন্দ্রে পাঠায়।
বছরজুড়ে দিল্লি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন সংস্থা মসজিদ ভেঙে সেই স্থানে হিন্দু মন্দির নির্মাণসহ উপাসনালয় দখল এবং ধ্বংস করার কাজে সহায়তা করেছে। উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যায়, জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী মোদি অযোধ্যায় রাম মন্দিরের পবিত্রতা ঘোষণা করেন। এরপর ছয় রাজ্যজুড়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ শুরু হয়। কর্তৃপক্ষ বারবার ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯৫ ধারা লঙ্ঘন করেছে। এ দণ্ডবিধিতে মসজিদসহ মুসলমানদের মালিকানাধীন সম্পত্তি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দিয়ে ধ্বংস করাকে ‘অবৈধ’ বলে ঘোষণা করেছে।
কর্তৃপক্ষ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে বৈষম্যমূলক রাজ্যস্তরের ধর্মান্তরবিরোধী আইন এবং গোহত্যা আইন প্রয়োগ করেছে।
গরু জবাই আইন আরোপের আড়ালে মুসলমানরা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছেন। জাতীয় নির্বাচনের পর ‘গো-রক্ষক’ সম্পর্কিত আনুমানিক ডজনখানেক হামলা ঘটেছে। এর মধ্যে আগস্টের একটি ঘটনাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যেখানে একদল গো-রক্ষক গরুর মাংস খাওয়ার মিথ্যা অভিযোগে একজন মুসলমান অভিবাসী শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা করে। এর একদিন পরে একদল হিন্দু ৭২ বছর বয়সি একজন মুসলমানের ওপর হামলা চালায়। কারণ তারা ধারণা করেছিল সে তার ব্যাগে গরুর মাংস নিয়ে যাচ্ছে। ওই একই মাসে, ‘গো-রক্ষক’দের একটি দল ১৯ বছরের এক হিন্দু ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করে, কারণ তারা ধারণা করেছিল সে একজন মুসলমান গরু পাচারকারী।
জুন এবং জুলাই মাসে, উত্তরপ্রদেশের পুলিশ রাজ্যের ধর্মবিরোধী সংস্করণ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে চারজন যাজকসহ ২০ খ্রিষ্টানকে আটক করে। জুলাই মাসে উত্তরপ্রদেশ সরকার এই আইনকে শক্তিশালী করার জন্য একটি বিলে ধর্মান্তরের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বৃদ্ধি করে। উত্তরপ্রদেশের হাইকোর্ট পরবর্তীতে ইসলামি চিন্তাবিদ কলিম সিদ্দিকী এবং আরও ১১ জনকে জোর করে ধর্মান্তরে অংশগ্রহণের অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। এ ছাড়া উত্তরাখন্ড একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিল পাশ করে যার মাধ্যমে আন্তঃধর্মীয় দম্পতিদের নিবন্ধনের অনুমতি দেওয়া হয়।
ভারত সরকার বিদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে শিখ সম্প্রদায়ের সদস্যদের এবং তাদের সমর্থকদের লক্ষ্য করে দমনমূলক কৌশল প্রসারিত করে চলেছে। ভারতের ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনের দায়ে নথিভুক্ত সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ এবং নাগরিক সামাজিক সংগঠনের কনস্যুলার পরিষেবা না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ওভারসিজ সিটিজেন অব ইন্ডিয়া কার্ড বাতিল করা, সেই সঙ্গে সহিংসতা এবং নজরদারির হুমকি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন এবং কানাডা সরকারের গোয়েন্দা তথ্যে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে নিউইয়র্কে একজন আমেরিকান শিখ কর্মীর হত্যা প্রচেষ্টার সঙ্গে র-এর একজন কর্মকর্তা এবং ছয়জন কূটনীতিকের জড়িত থাকার অভিযোগকে সমর্থন করে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে রয়টার্স জানিয়েছে, এশিয়া তথা বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে চীনের প্রভাব ঠেকাতে ভারতকে একটি পছন্দের বিকল্প হিসাবে দেখে আমেরিকা। ফলে, কমিশনের সুপারিশমতো ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থাকে আমেরিকার প্রশাসন নিষিদ্ধ করে দেবে, সেই সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।
এদিকে, আনন্দবাজার পত্রিকা জানিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এ প্রতিবেদনের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমেরিকার ফেডারেল কমিশনের ওই রিপোর্টটি মন্ত্রণালয়ের নজরে এসেছে। তিনি বলেন, ‘ওই রিপোর্টে আবার পক্ষপাতমূলক এবং রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মূল্যায়ন করার ধারা জারি রয়েছে।’ আমেরিকার আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতাসংক্রান্ত কমিশন কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে ভুল ভাবে উপস্থাপিত করার চেষ্টা করেছে বলেও অভিযোগ করেছে নয়াদিল্লি।
মার্কিন কমিশনের রিপোর্টের সমালোচনা করে মুখপাত্র বলেন, ১৪৪ কোটি মানুষের দেশ ভারত। এখানে সব ধর্মের মানুষ রয়েছেন। আমেরিকার আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতাসংক্রান্ত কমিশন ভারতের বহুত্ববাদী চিত্র বা সব ধর্মের সহাবস্থানকে স্বীকৃতি দেবে, এমন কোনো আশা আমরা করি না।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন news@probashtime.com মেইলে।
