করোনা সংকটে চাকরি হারানো প্রবাসী ছাড়াও অবৈধভাবে বসবাসকারী বিপুল সংখ্যক কর্মীর দেশে ফেরার আশঙ্কা করছে সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো ঠেকাতে এখন থেকেই আন্তর্জাতিক ফোরামে দাবি তোলা দরকার। সেই সঙ্গে নিয়োগকর্তা ও সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে আর্থিক প্রণোদনা আদায় এবং দেশে ফেরা কর্মীদের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠনের পরামর্শ তাদের।
সাধারণ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন কারণে ডিটেনশন সেন্টারে আটক কয়েক হাজার বাংলাদেশি বাণিজ্যিক ফ্লাইটে প্রতি মাসে ফেরত আসতো। কিন্তু বর্তমানে বাণিজ্যিক ফ্লাইট স্থগিত থাকার কারণে ওসব দেশে ডিটেনশন সেন্টার পূর্ণ হয়ে গেছে এবং বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর জন্য দেশগুলি দর কষাকষি করছে।
ধারনা করা হচ্ছে কুয়েত থেকে প্রায় ৪৫০০, সৌদি আরব থেকে প্রায় ১০০০, জর্ডান থেকে প্রায় ৪০০০, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রায় ৬০০০ এবং ওমান থেকে প্রায় ১৫০০ বাংলাদেশিকে ফেরত আনতে হতে পারে। এছাড়া বাহরাইন থেকে আগামী তিন মাসের মধ্যে ১২০০০ শ্রমিক ফেরত আনতে হতে পারে বলেও খবর পাওয়া গেছে।
বিশ্বের অর্থনীতির খারাপ অবস্থা সম্পর্কে ধারনা আছে সরকারের এবং এর ফলে প্রবাসীদের ওপর প্রভাব নিয়ে ইতোমধ্যে পররাষ্ট্র, প্রবাসী কল্যাণসহ জড়িত অন্যরা চিন্তা শুরু করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এ বিষয়ে একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং আমাদের এ বিষয়ে একটি অবস্থান নিতে হবে।’
পররাষ্ট্র, প্রবাসী কল্যাণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা নিয়ে ওই কমিটি ফেরত আসা প্রবাসীদের কীভাবে সমাজে আত্মস্থ করে নেওয়া যায় সেটি নিয়ে কর্মপরিকল্পনা করছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
ইতোমধ্যে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, যারা ফেরত আসবে তাদের সাত লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাইয়ে দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা করবে তারা এবং এর ফলে দেশের ভেতরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেতে পারে এবং ওসব মানুষ খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকতে পারবে বলে জানান তিনি।
আরও পড়ুনঃ প্রবাসীরা বাংলাদেশের সম্পদ : পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বিশ্বের প্রায় ১৭০ দেশে কর্মরত প্রায় সোয়া কোটি বাংলাদেশি। কিন্তু বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে অভিবাসীদের অধিকাংশই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। ফলে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী দেশে ফিরতে বাধ্য হবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে কুয়েত, বাহরাইন মালদ্বীপসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশি কর্মী ফেরত আনার তাগিদ দিয়েছে সেসব দেশের সরকার। যদিও এ বিষয়ে কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি নানা পদক্ষেপ নেয়ার কথার জানিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী।
প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে অধিকাংশই কর্মহীন হয়ে পড়বে। এ বিষয়ে কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। সংকটকালে প্রবাসীদের ফেরত পাঠানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্মীদের ফেরত পাঠাতে চাইলে নিয়োগকর্তা ও সে দেশের সরকারের কাছ থেকে আর্থিক প্রণোদনাসহ সুযোগ সুবিধা আদায়ের ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে।
https://www.youtube.com/watch?v=x798Lg4RxQM&t=17s
রামরু প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, যেকোনো সংকটে যে দেশে অভিবাসীরা থাকবেন আর যদি তিনি নিয়মিত বা অনিয়মিত হন তার ভরণপোষণের দায়িত্ব গ্রহণকারীর দেশের। কর্মীদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে জোর দাবি তুলতে হবে।
অধিবাসী বিশেষজ্ঞ সুমাইয়া ইসলাম বলেন, প্রবাসীরা রাষ্ট্রের উন্নতি করেছে। প্রতি মাসে তারা রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশকে উন্নত করেছে। তাহলে যেসব শ্রমিককে দেশে পাঠানো হচ্ছে অবশ্যই সেই দেশের সরকারকে আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে পাঠাতে হবে।
এই দুঃসময়ে বিদেশে বৈধতা হারানো কর্মীদের সংকট কাটাতে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি, ফিরে আসা কর্মীদের জন্য তহবিল গঠন ও তাদের আবার পাঠাতে যথাযথ উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বাংলাদেশিদের একটি অংশ ‘ফ্রি ভিসা‘ নিয়ে যায় অর্থাৎ ভিসাতে যে কোম্পানির নাম উল্লেখ থাকে ওই কোম্পানিতে তারা কাজ না করে নিজেদের মতো অন্য কাজ খুঁজে নেয় এবং এই ব্যবস্থাটি অবৈধ। সৌদি আরবে কর্মরত ২০ লক্ষাধিক বাংলাদেশির মধ্যে এর সংখ্যা প্রায় তিন লাখ এবং তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই এখন কোনও কাজ নেই। ওমানেও প্রায় লক্ষাধিক প্রবাসী বেকার হয়ে দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছেন।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কূটনীতিক জানান, উপসাগরীয় ছয়টি দেশের অভিবাসন নীতি মোটামুটি একই ধরনের। এখন অর্থনীতি খারাপ হওয়ার কারণে তারা লোক নেওয়া বন্ধ করেছে এবং ওসব দেশে অপ্রয়োজনীয় অভিবাসীদের বিষয়ে তারা একটি অবস্থান নিচ্ছে।
ওমান, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত ও কাতারে প্রায় ২০ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি কাজ করছে এবং ওসব দেশে অর্থনীতি খারাপ হওয়ার কারণে একটি বড় অংশ ফেরত আসবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
এদিকে এ পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশে থাকা প্রবাসীদের পরিবারগুলোতে আর্থিক সংকট দেখা দিচ্ছে। কথা বলে বোঝা যাচ্ছে অনেকেই সংকটে পড়ে গেছেন। অনেক পরিবারেরই দুমাসের বেশি টাকা আসেনি, যেকারনে সামনে সংসার চালানো নিয়ে এখন অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে প্রবাসী অনেক পরিবারের। সবমিলিয়ে করোনাভাইরাস মহামারি বিশ্বজুড়ে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি করেছে তার বহুমুখী প্রভাব দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয়ে।
https://www.youtube.com/watch?v=_2LZqIFmTp4
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন news@probashtime.com মেইলে।
