বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে দেশের সব আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরে নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ বাড়ছে। এর ফলে বিমানবন্দরে সব ধরনের ইজারা মূল্য বাড়তে পারে। দর্শনার্থীদের প্রবেশ ফি থেকে শুরু করে কার্গো স্ক্যানিং, দোকান ভাড়া, পার্কিং, জলাশয়সহ সব ধরনের ইজারা মূল্য পুননির্ধারণের জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ইতোমধ্যে লিখিত প্রস্তাব পেশ করেছে।
এর আগে ২০১৩ সালের ১ মার্চ নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ নির্ধারণ করেছিল বেবিচক। এরও আগে ২০০৭ সালে একবার বাড়ানো হয়েছিল। তখনো বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেল ও জিনিসপত্রের খরচ বেড়ে যাওয়া এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে চার্জ বাড়ানো হয়। এখন আবার সেই অবস্থা পার করছে গোটা বিশ্ব। এমন বাস্তবতা তুলে ধরে ইজারা খরচ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে বেবিচক। এর পাশাপাশি ২০১৫ সালে জাতীয় বেতন স্কেল ঘোষিত হওয়ায় কর্মচারীদের বেতনভাতা বৃদ্ধির বিষয়টিও যুক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে প্রস্তাবে। বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান স্বাক্ষরিত প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, সর্বশেষ ২০১৩ সালে ইজারামূল্য বেড়েছে। ইতোমধ্যে ৮-৯ বছর পেরিয়ে গেছে।
জানা গেছে, ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রামের শাহ আমানত ও সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরের নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বেবিচক। সেখানে দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক প্রান্তিক ভবনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রতি বর্গফুটে বর্তমান চার্জ ১২০ টাকা। এটি ১৫০ টাকা করার কথা বলা হয়েছে শাহজালাল বিমানবন্দরের ক্ষেত্রে। আর শাহ আমানত ও ওসমানী বিমানবন্দরের ক্ষেত্রে ৮০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ১১০ টাকা।
শাহজালাল বিমানবন্দরে শীতাতপবহির্ভূত এলাকায় ৮০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ টাকা এবং বাকি দুটো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা করার প্রস্তাব করেছে বেবিচক। রেস্টুরেন্ট/লাউঞ্জের বেলায় ঢাকার বিমানবন্দরে ১২০ থেকে বাড়িয়ে ১৮০ টাকা, ঢাকার বাইরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১০০ থেকে বাড়িয়ে ১২৫ টাকা করার কথা বলা হয়েছে। ফ্লোর স্পেস শাহজালাল বিমানবন্দরে দৈনিক ৪ থেকে ১০ টাকা আর বাকি দুটির বেলায় দৈনিক ২ টাকা ৬৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৫ টাকা হারে ধরা হচ্ছে বর্গফুট হিসাবে।
বিমানবন্দরের এয়ারসাইড ব্যবহারে বোর্ডিং ব্রিজ হোল্ডিং লাউঞ্জের নিচে (ছাদের নিচে) ৮৫ থেকে ১১০ টাকা ধরা হচ্ছে শাহজালাল বিমানবন্দরে। আর শাহ আমানত ও ওসমানী বিমানবন্দরে ৭০ থেকে বাড়িয়ে ৯০ টাকা ধরা হতে পারে। এয়ারসাইডে নতুন করে যুক্ত করা হচ্ছে তিনটি স্পেস। প্রধান অ্যাপ্রোনসংলগ্ন খোলা জায়গার (ছাদের বাইরে) ক্ষেত্রে শাহজালালে ৩০ টাকা আর অন্য দুই বিমানবন্দরে ধরা হবে ২০ টাকা। অন্যান্য অ্যাপ্রোনসংলগ্ন খোলা জায়গায় ২৫ টাকা ধরা হবে ঢাকার বিমানবন্দরে।
ঢাকার বাইরে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দুটিতে এ খরচ ধরা হয়নি। তবে শাহজালালে উন্মুক্ত জমি/স্পেস বর্গফুটে ২০ টাকা আর বাকিগুলোয় ১০ টাকা নতুন সংযুক্তি দেখানো হয়েছে। বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ প্রান্তিক ভবনে ভাড়া নিতে হলেও বর্গফুট হিসাবে গুনতে হবে টাকা। এসি অঞ্চলে ৯০ থেকে বাড়িয়ে ১১০ টাকা ধরা হয়েছে ঢাকার বিমানবন্দরে। ঢাকার বাইরের গুলোয় ৭০ থেকে বেড়ে ধরা হচ্ছে ৮০ টাকা। আর নন-এসি হলে ৬৫ টাকার ভাড়া দিতে হবে ৯০ টাকা। ৫০ টাকার ভাড়া ৬০ টাকা। এর প্রথমটি বরাবরের মতোই ঢাকা ও ঢাকার বাইরের হিসাবে ধরা হয়েছে।
এবার আসা যাক অপারেশনাল ভবনে। এসি কক্ষ হলে শাহজালাল বিমানবন্দরে ৮০ টাকার ভাড়া ৯০ টাকা এবং ৬০ টাকার ভাড়া ৭০ টাকা। নন-এসি হলে ৬০ টাকার ফি ৭০ টাকা ও ৫০ টাকার ফি ৬০ টাকা। কার্গো ভবনে এসি কক্ষ ৮০ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ১০০ টাকা আর ৬০ টাকার খরচ ৭৫ টাকা। নন-এসি কক্ষ হলে ৬০ টাকার খরচ ৭৫ টাকা আর ৪০ টাকার খরচ ৫০ টাকা। ওয়্যার হাউস/গুদাম নন-এসি হলে ঢাকায় ৬০ টাকার খরচ ৭৫ টাকা আর ঢাকার বাইরে হলে ৪০ থেকে বেড়ে ৫০ টাকা।
একইভাবে বারান্দা এয়ারসাইড ও টাউন সাইড হিসাবে ভিন্ন চার্জ প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রতি ক্ষেত্রেই ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দর ও ঢাকার বাইরের দুই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চার্জ ভিন্ন ধরা হয়েছে। খালি জায়গা ভাড়া নিলে বছরে ছিল ১০০ টাকা বর্গফুট। এখন তা হবে মাসে ১৫ টাকা। ঢাকার বাইরে বছরে ৫০ টাকা ছিল তা এখন থেকে মাসে ১০ টাকা হিসাবে ধরা হচ্ছে। আবাসিক এলাকায় খালি জায়গা আগে ছিল বছরে ১০০ টাকা। এখন তা মাসে হবে ১০ টাকা।
এভাবে ৫০ টাকার খরচ ঢাকার বাইরের বিমানবন্দরগুলোয় মাসে ৮ টাকা ধরা হবে। ভবনের ভেতরে একতলা ইজারা নিয়ে দোতলা করলে ১ম তলা ১০০ শতাংশ, দোতলার ইজারা মূল্য ৫০ শতাংশ হিসাবে এবং ভবনের বাইরে খোলা জায়গা নিয়ে দুই বা তিন তলা নিয়ে ১ম তলা প্রযোজ্য মূল্যের ১০০ শতাংশ, ২য় তলা ৬০ শতাংশ এবং ৩য় তলা ৪০ শতাংশ হারে প্রযোজ্য হবে। সূত্র জানায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বহুতল কারপার্কিং ফিও বাড়ানো হচ্ছে। কার হলে ১ম তিন ঘণ্টার জন্য এখন নেওয়া হয় ১০০ টাকা। এটি ২০ শতাংশ বেড়ে ১২০ টাকা করা হবে।
মাইক্রোবাস বা জিপ হলে ৩ ঘণ্টার বেশি ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত চার্জ ধরা হচ্ছে ৪০ টাকা। এটি এখনো তাই আছে। শাহজালাল বিমানবন্দরের টার্মিনালের বাইরের কার পার্কিংয়ে খরচ বাড়ছে। বাস, মিনিবাস ১৫০ টাকা থেকে বেড়ে হবে ২০০ টাকা। শাহ আমানত ও ওসমানী বিমানবন্দরে কার পার্কিং ফি প্রায় একই থাকছে; চার্জ বাড়ছে না। তবে অন্যান্য বিমানবন্দরে পার্কিং ফি কার, জিপ ও মাইক্রোবাস ৩০ টাকার পরিবর্তে ৪০ টাকা ধরা হচ্ছে। বিমানবন্দরে দর্শনার্থীদের প্রবেশ ফি ও টয়লেট ব্যবহারের খরচ অপরিবর্তিত থাকছে।
কক্সবাজার বিমানবন্দরে নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ বাড়ছে। প্রতি বর্গফুটে ৪০ টাকার ভাড়া ৫০ ও ৬০ ধরা হচ্ছে। উন্মুক্ত জমির খরচ ৫০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দেখা গেছে। কক্সবাজারের বাইরে অন্য অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরগুলোয় ৩০ টাকার ফি ৪০ টাকা ধরেছে। কিছু ক্ষেত্রে ৩৫ টাকাও ধরা হয়েছে। নতুন সংযোজন করা হয়েছে এয়ারসাইড চার্জ। বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রেও নতুন চার্জ ধরেছে বেবিচক। বার্ষিক খরচ ফুট হিসাবে ১৫০০ টাকার চার্জ ২০০০ টাকা। একইভাবে ৮০০ টাকার ফি ১০০০ টাকা।
বিমানবন্দরে নির্মিত রেস্ট হাউস/সিএসটিসি হোস্টেলে আসা অতিথিদের জন্য ৪০০ টাকার ফি ৮০০ টাকা। এ ছাড়া কক্ষ, অডিটরিয়াম, রিফ্রেশমেন্ট রুম ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি ব্যবহারের ভাড়া বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এ ছাড়া শুটিং করার ভাড়া, কার্গো স্কানিং চার্জ সবই বাড়ছে। শাহজালাল বিমানবন্দরে রপ্তানি কার্গো চার্জ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সেমি অটোমেশনসহ প্রতি কেজি ৬ সেন্ট। প্রস্তাবিত চার্জ সেমি অটোমেশন ছাড়াই সাধারণ স্ক্যানিং কেজিপ্রতি ৬ সেন্ট।
এ ছাড়া সেমি অটোমেশন ও ইডিএসসহ প্রতি কেজি ৮ সেন্ট। এখন ইডিএস স্ক্যানিংয়ে কেজিপ্রতি ৮ সেন্ট ধরার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি শাহজালাল বিমানবন্দরের চার্জ। বাকি দুই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নতুন করে চার্জ ধরা হচ্ছে। সাধারণ মেশিন ও ইডিএস মেশিনে কেজিপ্রতি ৪ ও ৬ সেন্ট হিসাবে। বর্তমানে এসব চার্জ নেই। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমদানি কার্গোর স্ক্যানিং চার্জ কেজিপ্রতি ১ সেন্ট প্রস্তাব করা হয়েছে। বেবিচকের এসব প্রস্তাব বাস্তবায়নের আগে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে বৈঠক করবে। তাদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
