নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের শম্ভুপুরা ইউনিয়নের চরকিশোরগঞ্জ গ্রামের কবির হোসেন ভাগ্য ফেরাতে প্রবাসে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন।
গতকাল সোমবার সকালে তার লাশ চরকিশোরগঞ্জ নিজ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। লাশ আনার পর এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। সেখানে আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে উঠে।
জানা গেছে, ৮ লাখ টাকার বিনিময়ে পরিচিত এক দালালের মাধ্যমে তিনি ঢাকার পুরানা পল্টনের বিকে ইন্টারন্যাশনাল লির্বাটি ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিডেট নামের একটি এজেন্সির মাধ্যমে ২০২৪ সালের ১৩ মে তিনি উজবিকিস্তান যান। সেখানে তাকে আটকে রেখে মুক্তিপনের জন্য শারিরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। অনাহার ও নির্যাতনে তিনি ১৩ জানুয়ারি মারা যান। পরিবার মুক্তিপনের ৮০ হাজার টাকা দিয়েও বাচাঁতে পারেননি কবির হোসেনকে। টাকা পাঠাতে দেরি হওয়ায় তার ওপর নির্যাতন বেড়ে যায়। কবির হোসেনের ভাগ্য তো ফিরলো না, কিন্তু তিনি লাশ হয়ে ফিরলেন নিজ বাড়িতে।
এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী কহিনুর বেগম বাদি হয়ে গত ১৯ জানুয়ারি বিকেলে সোনারগাঁ থানায় দু’জনকে আসামি করে অভিযোগ দায়ের করেন।
নিহতের বড় ভাই এবাদুল্লাহ জানান, উপজেলার শম্ভুপুরা ইউনিয়নের চর কিশোরগঞ্জ গ্রামের মো. আবুল কাশেমের ছেলে কবির হোসেন। তারা ৫ ভাই। ভাইদের মধ্যে কবির হোসেন আর্থিকভাবে দুর্বল ছিলেন। বাড়িতে থাকাবস্থায় তিনি রাস্তার পাশে পিঠা বিক্রি, অল্প পুঁজিতে মুদি ব্যবসা, কখনো অটোরিক্সা চালাতেন। বিভিন্ন এনজিও অথবা নির্দিষ্ট সুদের বিনিময়ে গ্রামীণ আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন। এক পর্যায়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চাপে তিনি বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরে আত্মীয়-স্বজন ও এনজিও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ ও ধার নিয়ে গত বছরের ১৩ মে উজবিকিস্তানে পাড়ি জমান। সেখান থেকে তার তুরস্ক যাওয়ার কথা ছিল তার। তুরস্ক নেওয়ার কথা বলে সেখানে একটি কক্ষে নিয়ে মুক্তিপণের জন্য আটকে রেখে তাকে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে পরিবারের কাছে টাকা পাঠাতে আকুতি জানান তিনি। আর্থিক দূরাবস্তায় পরিবার টাকা যোগাতে হিমশিম খাচ্ছিল। এক পর্যায়ে একটি বেসরকারী এনজিও থেকে ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সেই টাকা গত ১২জানুয়ারি রাসেল নামের একজনের মাধ্যমে সেখানে পাঠায় তারা। টাকা পাঠানোর পরদিন কবির হোসেনের মৃত্যু হয়।
বিষয়টি নিয়ে সোনারগাঁ থানায় অভিযোগ দায়েরের পর আদম ব্যবসায়ী মো. জাহিদ মিয়া বিদেশ যাওয়ার ৮ লাখ টাকাসহ মরদেহ আনতে রাজি হন। দীর্ঘ ৪৮দিন পর সোমবার সকাল সাড়ে ৫টার একটি ফ্লাইটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে মরদেহ আসা হয়। সেখানে তিনি মরদেহ গ্রহন করেন।
সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তার বাড়িতে মরদেহ নিয়ে আসলে সেখানে এক হৃদয়বিদারক ঘটনার অবতরণা হয়।
পরে বাদ যোহর চরকিশোরগঞ্জ মদিনাতুল উলূম মাদ্রাসা ও এতিমখানা মাঠে জানাজা শেষে পঞ্চায়েত কবরস্থানে কবিরের মরদেহ দাফন করা হয়। উজবিকিস্তানে কবির হোসেনের মৃত্যুর পর থেকে বিকে ইন্টারন্যাশনাল লির্বাটি ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিডেট নামের এজেন্সির মালিক মো. কালাম মান্নানসহ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তাদের অফিসে তালা ঝুলিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। সেখানে নিহতের পরিবার একাধিকবার গেলে তাদের অফিস বন্ধ পান। তাদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
নিহতের ফুফাতো ভাই রফিকুল ইসলাম বলেন, কবির হোসেনের দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। আর্থিক দুরাবস্থায় পড়ে ভাগ্য ফেরাতে বিদেশ গিয়েছিলেন। কে জানৎ তার এ পরিণতি হবে? তার দু’ চালা ঘরের দরজা পর্যন্ত নাই। পুরনো কাপড় ঘরের দরজা হিসাবে ব্যবহার করে। কবির হোসেনের মৃত্যুতে তার পরিবার অথৈ সাগরে হাবুডুব খাচ্ছে।
নিহতের স্ত্রী কহিনুর বেগম জানান, তুরস্ক যাওয়ার জন্য ৮লাখ টাকা জমা দিয়ে উজবিকিস্তান নেওয়ার পর তাকে একটি কক্ষে নিয়ে টাকার জন্য প্রতিদিন মারধর করা হয়। প্রতিদিন মোবাইল ফোনে আমাদের কাছে কান্না করত। দ্রুত টাকা পাঠিয়ে তাকে তাদের কাছ থেকে মুক্ত করতে বলত। তাকে তেমন খাবার দিত না। বরফের পানি খেয়ে ও তাদের নির্যাতনে তিনি মারা যান।
বলতে বলতে তার স্ত্রী এক পর্যায়ে মুর্ছা যান। খানিক পর আবার তিনি বলেন, ‘একটি এনজিও থেকে ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে রাসেল নামের একজনের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়েছি। রাসেলও সেই টাকা নির্যাতনকারীদের দেননি। আমাদেরকেও ফেরত দেননি। আমার ৫ সন্তান নিয়ে এখন সাগরে পরে আছি। আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই।
নারায়ণগঞ্জ জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার( খ- অঞ্চল) আসিফ ইমাম বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ খবর নিয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন news@probashtime.com মেইলে।
